একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে
পরিবার ও প্রতিবেশী দায়িত্ব
পরিবার ও প্রতিবেশী দায়িত্ব
মাদকাসক্ত বন্ধুকে রক্ষার প্রথম কাজ চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। মনে রাখতে হবে, বিষয়টি সহজ নয়, কঠিন। কিন্তু সম্ভব। দেহ-মন, ক্যারিয়ার, পারিবারিক জীবন ও আর্থিক অবস্থা ধ্বংস হচ্ছে, একসময় বোঝে আসক্ত ব্যক্তি। তবু জীবনযাপনে ধ্বংসের পথে সেঁটে থাকার কারণে প্রতিদিনের ডোজ সংগ্রহের জন্যই বেপরোয়া ইচ্ছা জেগে থাকে তাদের মনে—আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা ও উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু দখল করে নেয় মাদকের টান। সব ক্ষতি মেনেই ওই টানে ঘুরপাক খেতে থাকে তাদের জীবন। মাদকের কারণে কী ক্ষতি হচ্ছে, কী হারাচ্ছে সে, এসব কথা বলে খুব একটা লাভ হয় না। তবে চিকিৎসার একটা ধাপে আলোচনা করা হয় ক্ষতি নিয়ে। মাদকাসক্ত বন্ধুকে চিকিৎসাiজন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে, এটাই মূল কথা, বড় দায়িত্ব। প্রথম শর্ত হচ্ছে, মনোযোগী শ্রোতা হওয়া। মাদকাসক্তি নিয়ে আসক্ত ব্যক্তি কী ভাবছে, কেন মাদক নেওয়া শুরু করেছে, তাকে বলার সুযোগ দিতে হবে। সক্রিয়ভাবে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তার কথা (Active listening), শোনার জন্য তৈরি করে দিতে হবে সহজ পরিবেশ। শোনার সময় উৎসাহ দিতে হবে, খোলামেলাভাবে কথা বলার সুযোগ পেলে, উৎসাহ পেলে, কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে সে। মাদক ছাড়ার জন্য প্রস্তুত কি না, প্রয়োজনে তলিয়ে দেখতে হবে বিষয়টি। শোনার সময় থাকতে হবে Emphatic Approach অর্থাৎ সতেজ পদ্ধতি; সহানুভূতি নয়, করুণা নয়। আসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি থাকতে হবে সম্মানবোধ। তার কথার পিঠে কথা বলা ঠিক হবে না। তার বক্তব্যের সমালোচনা করা যাবে না, তাকে দোষ দেওয়া যাবে না, রাগ দেখানো চলবে না, ঘৃণা করার প্রশ্নই আসে না। নিজের বিশ্বাস, মনোভাব, চিন্তা কিংবা মূল্যবোধ ও আচরণ আসক্ত ব্যক্তিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না। কথা বলার সময় মাদক গ্রহণকে যদি সে সমস্যা হিসেবে মেনে নেয়, বুঝতে পারে মাদকাসক্তি মানে ব্রেনের রাসায়নিক নির্ভরতা; যদি সাহায্য সে চায়, তার জন্য ভালো কিছু করার পথ খুলে যাবে তখন। এ অবস্থায় তাকে সহজে সহায়তা করা সম্ভব।
সাহায্য চাইলে, পরবর্তী ধাপে পরিবারের সদস্যদের জানাতে হবে। প্রাথমিকভাবে আসক্ত ব্যক্তি পরিবারের সদস্যদের জানাতে চাইবে না। জানানোর উদ্যোগ নিলে চিকিৎসা গ্রহণে রাজি হবে না। লেগে থাকতে হবে। ধীরে ধীরে মেনে নেবে পরিবারের সহযোগিতা। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে হবে যে সন্তান নষ্ট হয়নি, ‘ক্রনিক রিলাপসিং ব্রেন ডিজিজে’ আক্রান্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে উচিত পরিবারের সবার তার পাশে দাঁড়ানো। অন্য ভালো বন্ধুদেরও এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ ও ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সবার সম্মিলিত উৎসাহে আসক্ত বন্ধুকে চিকিৎসার জন্য রাজি করানো সম্ভব। উদ্বুদ্ধকরণের পথটি নানা জটিলতায় ভরা।
মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের সমস্যা
সন্তান মাদকাসক্ত, এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চোট খাবেন তাঁরা, প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইবেন না। বিশ্বাস করলেও খেপে উঠতে পারেন, রাগারাগি, বকাঝকা, মারধর, ঘরে আটকে রাখা, সমালোচনা করা চলতেই থাকবে। এসময় তাঁদের পাশেও দাঁড়াতে হবে। পরিবারের সদস্যদেরও বোঝাতে হবে, আসক্তজন ফাঁদে আটকা পড়েছে, গর্তে পড়ে গেছে, চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে। এই ফাঁদ, গর্ত কিংবা চোরাবালি থেকে তুলে আনতে হবে তাকে, আরও বেশি মমতা ও ভালোবাসা দরকার। হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তার প্রতি। যত বেশি রূঢ় আচরণ করা হবে, তত দূরে সরে যাবে সে, তত বেশি ডুবে যাবে, সর্বনাশ ঠেকাতে অভিভাবকদের উদ্যত আবেগ সংযত করতে হবে প্রথম। এর কোনো বিকল্প নেই।
আসক্ত ব্যক্তির সমস্যা
আসক্ত ব্যক্তি জানে, খারাপ কাজ করছে সে, সমাজের চোখে বিষয়টি খারাপ, গ্রহণযোগ্য নয়। তাই লুকাতে থাকবে আসক্তির কথা! অস্বীকার করবে, বুদ্ধিমানের মতো আলোচনা এড়িয়ে যাবে। কিন্তু মূল টার্গেট হবে অস্বীকারের বৃত্ত থেকে তাকে বের করে আনা, আড়ালে থাকার গোপন পর্দা সরিয়ে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে বিতর্ক না করে ধৈর্যের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। স্বীকারোক্তির পরও অনেক অজুহাত তুলে ধরবে সে। বলতে পারে, ‘আর মাদক নেব না’, ‘ছেড়ে দিলাম আজ থেকে’ এবং ‘আমার ইচ্ছাশক্তি প্রধান’। বলতে পারে, ‘নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই’, ‘এক মাস, তিন মাস, ছয় মাস নিরাময়কেন্দ্রে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই’, ‘এত টাকা কোথায় পাব’ ইত্যাদি। চাকরিজীবী হলে বলবে, ‘আমার ছুটি নেই’, ‘চাকরি চলে যাবে’ এবং ‘চাকরি চলে গেলে আরও খারাপ হয়ে যাব’। ছাত্র হলে বলবে, ‘আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে’, ‘সামনে পরীক্ষা’ ইত্যাদি যুক্তি তুলে ধরবে, ধ্বংসের পথে চলতেই থাকবে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভালো উপায় হচ্ছে, নরমভাবে তার বক্তব্য ও আচরণের অসামঞ্জস্যতা (Inconsistencies) সামনে তুলে ধরা। মনে রাখতে হবে, এই তুলে ধরার বিষয়টি হতে হবে শালীনভাবে, দক্ষতার সঙ্গে। জোর পূর্বক মত দ্বৈধতা দেখানো চলবে না, রিঅ্যাকশন দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তাকে দোষ দেওয়াও যাবে না। আরও মনে রাখতে হবে, আসক্তজনের অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা, আচরণের ব্যাখ্যা মেনে নেওয়াও যুক্তিযুক্ত হবে না, উপকারী তো নয়ই। বরং সমস্যা জিইয়ে রাখবে অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা।
আসক্ত ব্যক্তিকে নষ্ট, চরিত্রহীন, কুলাঙ্গার ইত্যাদি বলা অথবা সন্তান হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা, ঘর থেকে বের করে দেওয়া মানেই হলো তার মস্তিষ্কে আসন নেওয়া ‘রাসায়নিক বোমা’ বিস্ফোরণের জন্য উসকে দেওয়া, ‘ফুয়েল’ ঢেলে দেওয়া।
অনেক সময় মাদকসেবীর ধর্মবিশ্বাস যৌক্তিক সময়ে তুলে ধরে মাদক ছাড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যায়। ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে (যদি সেটা থাকে তার বিশ্বাসে) সে যে সমস্যার জালে জড়িয়ে আছে, বোঝানো যায় তাকে। অন্তর্গত এই বোঝাপড়াই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য নতুন পথ দেখাবে আসক্ত ব্যক্তিকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন তার ভালো গুণগুলো সামনে তুলে ধরে প্রশংসা করা এবং খারাপ কাজের জন্য শ্লেষাত্মক শব্দ ব্যবহার না করা।
সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে অপেক্ষা করতে হবে বিশেষ মুহূর্তের জন্য, যেমন আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া (এমনটি যেন না হয়), চাকরিচ্যুত হওয়া, পরীক্ষায় ফেল করা বা পুলিশের হাতে ধরা পড়া। তখন মাদক বর্জনের ইস্যুটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করানো সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, অতি উত্তেজিত হয়ে রোগীকে কারাগারে প্রেরণ করা এবং রুমে তালাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। এর ফলে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি জটিল হতে থাকে। কারাগার কিংবা বদ্ধ ঘর থেকে ছাড়া পেয়ে সে আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে যাবে। বদ্ধ ঘরে আত্মহননের চেষ্টাও চালাতে পারে, ঘটেছে এমন ঘটনা আমাদের দেশেও।
বিকল্প কাজ হচ্ছে, আসক্ত ব্যক্তিদের অতি ঘনিষ্ঠ কারোর সাহায্য নেওয়া। তার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া।
জেনে রাখা ভালো, আসক্ত ব্যক্তির মন দুই ভাগ হয়ে যায়, এক মন বলে মাদক ছেড়ে দেব; আরেক মন বলে ছাড়া যাবে না, ছাড়লে কষ্ট হবে। তবে চিকিৎসার একপর্যায়ে বিভক্ত মন জোড়া লাগিয়ে ইচ্ছাশক্তি জোরালো করা সম্ভব। নিজের ও পারিবারিক উদ্যোগ বিফল হলে মাদকাসক্তি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ কোনো কাউন্সেলর, অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট বা অভিজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। লেগে থাকতে হবে। বিফলে হতাশ হলে চলবে না। লেগে থাকলে অবশ্যই সফলভাবে আসক্ত ব্যক্তিদের রাজি করানো যায়।
কঠিন ভয়াবহতায়ও হতাশ হলে চলবে না। সাফল্য আসবেই..
ধন্যবাদ,
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন